ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয় জেনে নিন
প্রিয় পাঠক, আসসালামু আলাইকুম। আপনি কি জানেন ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয়? যদি না জেনে থাকেন ও জানতে আগ্রহী হন, তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। এই আর্টিকেলে আমরা ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তাই সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ার অনুরোধ রইলো।
এছাড়াও ভিটামিন এ এর অভাবজনিত লক্ষণ, ভিটামিন এ এর উৎস এ সম্পর্কেও ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
কনটেন্ট সূচিপত্র: ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয়
ভূমিকা
ভিটামিন ‘এ’ হলো একধরনের fat-soluble ভিটামিন। fat-soluble ভিটামিন গুলো: (ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে) ফ্যাট বা তেলে দ্রবীভূত হয়ে বা ভেঙ্গে দেহে শোষিত হয় বা কাজে লাগে। ভিটামিন ‘এ’ একটি পুষ্টি উপাদান হলেও এর দুটি গ্রুপ রয়েছে। যথা: preformed vitamin A ও provitamin A বা carotenoids.
preformed vitamin A প্রাণীজ উৎসে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। অন্যদিকে, provitamin A সাধারণত উদ্ভিজ্জ উৎসে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। preformed vitamin A ও provitamin A রুপান্তরিত হয়ে রেটিনাল ও রেটিনোইক অ্যাসিড এ পরিণত হয়। তারপর অবশেষে ভিটামিন এ দেহে শোষিত হয়ে পুষ্টি সরবরাহ করে।
ভিটামিন এ এর কাজ কি
ভিটামিন এ আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি পুষ্টি উপাদান। ভিটামিন ‘এ’ এর প্রচুর স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, কোষ বা টিস্যুর গঠন ও ক্ষতিপূরণ, সুষ্ঠু প্রজননের জন্য অপরিহার্য। ভিটামিন এ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে। ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার খেলে চোখের কর্নিয়া ও রেটিনাস ভালো থাকে। এছাড়াও এর ফলে চোখের সংক্রামক রোগ, রাতকানা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
ভিটামিন এ এর উৎস
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যে preformed vitamin A ও provitamin A পাওয়া যায়। preformed vitamin A খুব সহজেই দেহে শোষিত হয়ে যায় এবং দেহে ভিটামিন এ সরবরাহ করে। provitamin A বা carotenoids সহজে দেহে শোষিত হতে পারে না। preformed vitamin A প্রাণীজ উৎসে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, provitamin A সাধারণত উদ্ভিজ্জ উৎসে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। তাই যারা নিরামিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করেন, তাদের ডায়েটে পর্যাপ্ত পরিমাণে provitamin A গ্রহণ করার ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে।
preformed vitamin A যেসব খাবারে পাওয়া যায় তার তালিকা দেওয়া হলো:
- গরুর কলিজা।
- মুরগির কলিজা।
- ডিমের কুসুম।
- কর্ড লিভার অয়েল।
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার। যেমন: মাখন, পনির।
- সামুদ্রিক মাছ। যেমন: স্যালমন, টুনা, হেরিং ইত্যাদি।
provitamin A বা carotenoids যেসব খাবারে পাওয়া যায় তার তালিকা দেওয়া হলো:
- কুমড়া।
- গাজর।
- পেঁপে।
- মিষ্টি আলু।
- গোল মরিচ।
- সবুজ বা উজ্জ্বল রংয়ের শাকসবজি। যেমন: পালং শাক, ফুলকপি, পাতাকপি, ইত্যাদি।
ভিটামিন এ জাতীয় ফলের নাম
সাধারণত ফলমূলের তুলনায় শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। তবুও কিছু এমন ফল রয়েছে যেগুলো তে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। নিচে ভিটামিন এ জাতীয় ফলের নাম দেওয়া হলো:
- তরমুজ।
- পেঁপে।
- পেয়ারা।
- আম।
- জাম্বুরা।
- এপ্রিকট।
- কমলা লেবু।
- টমেটো জুস।
ভিটামিন এ এর অভাবজনিত লক্ষণ
ভিটামিন এ এর অভাবজনিত লক্ষণ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে বেশি দেখা যায়, যেখানে খাদ্য ও পুষ্টির সংকট রয়েছে। ভিটামিন এ অভাবজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বুকের দুধ খাওয়ানো মা, গর্ভবতী মহিলা, শিশু ও বাচ্চাদের। ভিটামিন এ এর অভাবজনিত লক্ষণ গুলো দেওয়া হলো:
বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভধারণে অক্ষমতা- ভিটামিন ‘এ’ নারী ও পুরুষ উভয়ের ই প্রজনন এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরা দেখেছেন, দেহে ভিটামিন এ এর অভাব দেখা দিলে বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভধারণ জনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। যদি কোনো নারী গর্ভধারণ করতে অক্ষম হন, তাহলে তার পিছনে অন্যতম কারণ হতে পারে দেহে ভিটামিন এ এর ঘাটতি। এছাড়াও ভিটামিন এ এর অভাবে নারী-পুরুষ উভয়ের বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।
ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া- ভিটামিন এ ত্বকের টিস্যু গঠন ও ক্ষতিপূরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। এছাড়াও ভিটামিন এ ত্বকের বিভিন্ন রোগ ও প্রদাহ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। দেহে ভিটামিন এ এর অভাব দেখা দিলে একজিমা রোগ হয়। একজিমা হলো একধরনের চর্মরোগ যার কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়, ত্বকে চুলকানি ও প্রদাহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু মনে রাখবেন, ত্বক শুষ্ক হওয়ার পিছনে আরো অন্যান্য কারণ ও থাকতে পারে।
শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়- ভিটামিন এ এর অভাবজনিত কারণে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। পুষ্টিবিদরা কিছু শিশুর উপর পরীক্ষা করে দেখেছেন, যে সকল শিশুর দেহে ভিটামিন এ এর অভাব রয়েছে তাদের শারীরিক বৃদ্ধি বিলম্বিত হয় বা ধীরগতিসম্পন্ন হয়।
চোখের সমস্যা দেখা দেয়- ভিটামিন এ এর কারণে চোখের সমস্যা হওয়া টা খুবই প্রচলিত একটি লক্ষণ। ভিটামিন এ এর ঘাটতি দেখা দিলে-
- চোখের দৃষ্টি ঝাপসা বা অস্পষ্ট হয়ে যায়।
- চোখের পানি উৎপাদন করার ক্ষমতা হারিয়ে যায় ও চোখের পানি শুকিয়ে যায়।
- চোখের কর্নিয়া মৃতপ্রায় হয়ে যায়। এমনকি মানুষ অন্ধ পর্যন্ত হতে পারে।
- গলা ও বুকে সংক্রমণ দেখা দেয়- ভিটামিন এ এর অন্যতম অভাবজনিত লক্ষণ হলো গলা ও বুকে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন বা সংক্রমণ দেখা দেওয়া। ভিটামিন এ এর অভাবে Respiratory tract infection (RTI) হয়, যেটি শ্বাসযন্ত্রের একটি রোগ।
ক্ষতস্থান দ্রুত নিরাময় হয় না- ভিটামিন এ এর অভাবে দেহ যেকোনো আঘাত বা ক্ষতস্থান সহজে সারিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও ক্ষতস্থান সম্পূর্ণ ভাবে নিরাময় হতে অনেক দেরি হয়। এর কারণ হলো ভিটামিন এ কোলাজেন নামক প্রোটিন উৎপন্ন করে যেটি আমাদের ত্বক সুস্থ ও সুন্দর রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্রণের সংক্রমণ দেখা দেয়- ভিটামিন এ এর অভাবে বিভিন্ন ত্বকের প্রদাহ বা সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্রণ ও একনে ব্রেকআউট। যেহেতু ভিটামিন এ ত্বক সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। সুতরাং, এর ঘাটতির কারণে ত্বকের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগ ও প্রতিকার
ভিটামিন এ এর অভাব জনিত রোগ হওয়া খুবই দুর্লভ একটি বিষয়। কারণ, যেকোনো ভিটামিন ও মিনারেল এর চাহিদা খাবারের মাধ্যমে খুব সহজেই পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন রোগব্যাধি, যেমন: ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, লিভারের রোগ ইত্যাদির কারণে ভিটামিন এ এর অভাব দেখা দেয়। ভিটামিন এ এর অভাবে যে প্রধান রোগটি দেখা দেয়, তা হলো রাতকানা রোগ। রাতকানা রোগের লক্ষণগুলো হলো-
- রাতে, অন্ধকারে কিংবা স্বল্প আলোতে স্পষ্ট দেখতে না পাওয়া।
- চোখের সাদা অংশ ও কর্নিয়া খুব শুষ্ক হয়ে যাওয়া। এর ফলে চোখের পানি উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়।
- আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা থাকতে পারে।
- দূরবর্তী যেকোন কিছু দেখতে অসুবিধা হয়।
প্রতিকার
ভিটামিন এ এর অভাবজনিত রোগ প্রতিকার করার সবচেয়ে সহজ ও কার্যকারী পদ্ধতি হলো ডায়েট বা খাদ্য তালিকায় ভিটামিন এ সমৃ্দ্ধ খাবার যুক্ত করা। প্রাকৃতিক ভাবেই বিভিন্ন খাবারে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। ফলমূল ও শাকসবজি বেশি বেশি খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এবং খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ গ্রহণ করতে না পারলে সাপ্লিমেন্ট বা ঔষধের সাহায্য নিতে হবে।
ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয়
ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয় এটা নিয়ে মা ও বোনেরা উদ্বিগ্ন থাকেন। শরীরে যেকোন ভিটামিন এর অভাব তখনই দেখা দেয় যখন খাবার ও সাপ্লিমেন্ট এর মাধ্যমে আমরা সেই ভিটামিন পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হই। চিকিৎসকদের মতে, ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের রাতকানা বা Night Blindness রোগ হয়।
রাতকানা রোগ কে ডাক্তার দের পরিভাষায় Nyctalopia বলা হয়। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ লক্ষ শিশু ভিটামিন এ এর অভাবে অন্ধ হয়ে যায়। রাতকানা রোগ চোখের রেটিনল সংক্রমণের কারণে হয়।
ভিটামিন এ ট্যাবলেট এর নাম
বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও জেনেরিক নামের ভিটামিন এ ট্যাবলেট পাওয়া যায়। নিচে বহুল পরিচিত ৬ টি ভিটামিন এ ট্যাবলেট এর নাম দেওয়া হলো:
- Lilfil-A 50000 IU (ACME Laboratories Ltd.)
- Ovit-A 50000 IU (Opsonin Pharma Ltd.)
- Ovit-A 200000 IU (Opsonin Pharma Ltd.)
- A-Forte 50000 IU (Globe Pharmaceutical Ltd.)
- Ratinol Forte 50000 IU (Drug International Ltd.)
- Vis-A 50000 IU (Pacific Pharmaceutical Ltd.)
কতটুকু ভিটামিন এ প্রয়োজন
যেকোন পুষ্টি উপাদান একটি নির্দিষ্ট পরিমাণেই গ্রহণ করলে সেটি আমাদের উপকারে আসবে। প্রয়োজনের তুলনায় কম কিংবা বেশি পরিমাণে ভিটামিন গ্রহণ করলে তা আমাদের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। The Recommended Dietary Allowance (RDA) এর নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন পুরুষের প্রতিদিন ৯০০ IU ও একজন নারীর প্রতিদিন ৭০০ IU পরিমাণ ভিটামিন এ গ্রহণ করা উচিত। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার মাধ্যমে এই চাহিদা সহজেই পূরণ করা সম্ভব।
Source: MedEx, Healthline, Medical News Today.
লেখকের মন্তব্য
প্রিয় পাঠক, আশা করছি আপনি ভিটামিন এ এর কাজ কি, ভিটামিন এ এর উৎস, ভিটামিন এ এর অভাবজনিত লক্ষণ, ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয় এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন ও উপকৃত হয়েছেন। যদি আপনার এই ধরনের বিশ্বস্ত ও তথ্যপূর্ণ আর্টিকেল পড়তে ভালো লাগে, তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটটি ফলো করতে পারেন।
কারণ আমরা এই ধরনের আর্টিকেল নিয়মিত প্রকাশ করে থাকি। আপনার কোন পরামর্শ বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। যদি এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনি উপকৃত হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার প্রিয়জন ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url